কারাগারের কনডেম সেলে ফাঁসির অপেক্ষায় রয়েছেন ২১০২ আসামি। এদের মধ্যে অনেকের মামলা হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্সের শুনানি চলছে। আবার অনেকের ডেথ রেফারেন্স শেষ হওয়ার পর আপিল করেছেন। যা আপিল বিভাগের বিচারাধীন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিচার প্রক্রিয়া শেষ না হওয়ায় বছরের পর বছর ধরে কনডেম সেলে থাকতে হচ্ছে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের। ডেথ রেফারেন্সের জটে কনডেম সেলে ফাঁসির আসামির সংখ্যা বাড়ছে। প্রতি বছরই বাড়ছে ডেথ রেফারেন্স মামলার সংখ্যা। মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাড়ছে ডেথ রেফারেন্স জট। মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আইন ও বিচার বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং মামলার সংখ্যা ও নিষ্পত্তির অগ্রগতি নিয়মিত মনিটরিং করতে কারা অধিদপ্তরকে নির্দেশনা দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ। সম্প্রতি সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে এক বৈঠকে এ নির্দেশনা দেয়া হয়।
বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া প্রতিশ্রুতি ও নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য এ বৈঠকের আয়োজন করা হয়। বৈঠকে কারাগারে থাকা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মামলা জট কমানোর পাশাপাশি গুরুতর অসুস্থ বন্দিদের মুক্তির বিষয়ে আলোচনা হয়। এ ছাড়া জেলখানায় বন্দিদের জঙ্গি সম্পৃক্ততা নিয়ন্ত্রণ নিয়েও আলোচনা হয়।
সভায় জানানো হয়, কারা অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট ১৮টি নির্দেশনা ও প্রতিশ্রুতি রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর। এর মধ্যে ৯টি নির্দেশনা ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বাকি ৯টি নির্দেশনা বাস্তবায়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিভিন্ন মামলায় মৃত্যুদণ্ড প্রদত্ত আদেশগুলো দ্রুত কার্যকর করতে উদ্যোগ নিতে নির্দেশনা ছিল প্রধানমন্ত্রীর। প্রয়োজনে আলাদা সেল গঠন এবং আইন মন্ত্রণালয়ের সহায়তা গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। সভায় জানানো হয়, গত ৩১শে আগস্ট পর্যন্ত ২২৬৫টি মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত বন্দির সংখ্যা ২১০২ জন। মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত বন্দিদের উচ্চ আদালতে চলমান ডেথ রেফারেন্স এবং আপিল মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সমন্বিতভাবে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম পরিচালনা এবং এ বিষয়ে সরকারের নিকট সুপারিশ প্রদানের নিমিত্তে গঠিত কমিটির ১২তম সভার সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনে ২১৫ জন বন্দির অনিষ্পন্ন মামলার মধ্যে জুন পর্যন্ত হাইকোর্ট বিভাগে ২৯টি এবং আপিল বিভাগে ১০টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনে ২১৫ জন বন্দির অনিষ্পন্ন মামলার মধ্যে কোনো মামলা কতো বছরের পুরনো তার পরিসংখ্যান প্রতি মাসে সুরক্ষা সেবা বিভাগে প্রেরণ করা হচ্ছে।
চলমান মামলাসমূহের মধ্যে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সময়ে হাইকোর্ট বিভাগে ২৯টি এবং আপিল বিভাগে ১০টি মামলার নিষ্পত্তি করা হয়েছে। মামলাসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে আইন ও বিচার বিভাগের সঙ্গে এ বিভাগ থেকে দাপ্তরিক ও ব্যক্তিগত যোগাযোগ অব্যাহত রাখা এবং মামলাসমূহের মধ্যে চলতি বছরে কতোটি আপিল মামলা ছিল এবং কতোটি নিষ্পত্তি করা হয়েছে তা তালিকা করে সুরক্ষা সেবা বিভাগে প্রেরণের জন্য কারা অধিদপ্তরকে নির্দেশনা দেয়া হয়। কারাবন্দিদের মধ্যে জঙ্গি সম্পৃক্ততা নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে কারারক্ষীদের টেরোরিজম প্রতিরোধ বিষয়ক প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত বিষয়ে সভায় আলোচনা হয়। এসময় সংশ্লিষ্টরা জানান, কারাবন্দিদের মধ্যে জঙ্গি সম্পৃক্ততা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে টেরোরিজম প্রতিরোধ বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান কার্যক্রম চলমান আছে। কারা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা দপ্তর, মার্কিন দূতাবাস, বিভিন্ন সংস্থার সহায়তায় ১৯৮ জন এবং ডেপুটি জেলার মৌলিক প্রশিক্ষণে আরও ১৩ জনসহ মোট ২১১ জন কারা কর্মকর্তাকে দেশে এবং ৮ জন কারা কর্মকর্তাকে বিদেশে টেরোরিজম প্রতিরোধ বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে কর্মরত ৮৭০৮ জন কারারক্ষী ও মহিলা কারারক্ষীর মধ্যে ৪৪৯৩ জনকে টেরোরিজম প্রতিরোধ বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে অবশিষ্ট ৪২১৫ জন কারারক্ষী ও মহিলা কারারক্ষীকে টেরোরিজম প্রতিরোধ বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদানের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
কারাগারকে বন্দিশালা নয় সংশোধনাগারে পরিবর্তন করা সংক্রান্ত প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি নিয়ে সভায় আলোচনা হয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা জানান, কারাগারে আটক বন্দিদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশ ও বিদেশের শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। কারাবন্দিদের সংশোধনের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে কারা আইনকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে অপঃ- ২০২১ প্রণয়নের কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে রয়েছে। কারাগারসমূহের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করাসহ বয়োবৃদ্ধ ও গুরুতর অসুস্থ কারাবন্দিকে কারামুক্তির বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশনা ছিল প্রধানমন্ত্রীর। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা সভায় জানান, জানুয়ারি ২০১৯ এ কারাগারের বন্দি ধারণক্ষমতা ছিল ৪০,৬৬৪ জন। ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা ও কক্সবাজার কারাগারে নতুন ভবন নির্মাণ এবং বিদ্যমান ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সমপ্রসারণের মাধ্যমে কারাগারসমূহের বন্দি ধারণক্ষমতা ১,৯৬২ জন বৃদ্ধি করা হয়েছে। বর্তমানে ধারণক্ষমতা ৪২,৬২৬ জন।
কারাগারের ধারণক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করার জন্য খুলনা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, নরসিংদী ও জামালপুর কারাগার নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ করা হচ্ছে। ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং বর্তমানে কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। বয়োবৃদ্ধ ও গুরুতর অসুস্থ ১৪ জন বন্দির মুক্তির লক্ষ্যে যথাযথ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। অচল, অক্ষম, দীর্ঘদিন যাবৎ জটিল এবং গুরুতর দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত বন্দিদের মুক্তির লক্ষ্যে সুরক্ষা সেবা বিভাগের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে কারা অধিদপ্তর থেকে ১৪ জন বন্দির মুক্তির প্রস্তাব সুরক্ষা সেবা বিভাগে প্রেরণ করা হয়েছে। জামালপুর, কুমিল্লা ও নরসিংদী কারাগারের নির্মাণকাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
দৈবীচ/এম/জ